সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রেম কাহিনী
পরিণত বয়সে সুনীল যাকে ভালবেসে ছিলেন তিনি ছিলেন একজন ফরাসী তরুণী। নাম মার্গারিট ম্যাথিউ। সাতাশ বছরের এই তরুণীর সঙ্গে সুনীলের সাক্ষাৎ হয়েছিল আমেরিকায়। সুনীল তথন মধ্য-পশ্চিম আমেরিকার আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্য বিভাগের ‘ক্রিয়েটিভ রাইটিং প্রোগ্রাম’-এ অংশ নিতে এক বছরের জন্য সেখানে গিয়েছিলেন। মার্গারিট ছিলেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়েরই ফরাসী বিভাগের শিক্ষিকা। সুনীল আইওয়া যাওয়ার দু’বছর আগে থেকেই তিনি সেখানে শিক্ষকতা করছিলেন।
মার্গারিটের আগ্রহ ছিল ভারতীয় পুরাণ ও সংস্কৃতিতে। অন্যদিকে সুনীলের গভীর অনুরাগ ছিল ফরাসী ভাষা ও সাহিত্যে। দু’জনে ছিলেন দু’জনার পরিপূরক। সুতরাং খুব দ্রুত তাদের মধ্যে অন্তরঙ্গতা হয়ে গিয়েছিল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা, কথনো বা সারাদিন দু’জন একই ঘরে গল্প করেছেন, ড্রিঙ্ক করেছেন, খাবার ভাগাভাগি করে খেয়েছেন, এমন কী মাসিক খরচও শেয়ার করেছেন। দু’জন এতটাই অন্তরঙ্গ হয়ে উঠেছিলেন যে, কেউ কাউকে ছাড়া দীর্ঘ সময় থাকতে পারতেন না।
সুনীল তার ‘ছবির দেশে, কবিতার দেশে’ শীর্ষক আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে তাদের সম্পর্ক ও ঘটনা প্রবাহের যে বর্ণনা দিয়েছেন, এতে এটুকু পরিষ্কার যে তাদের সম্পর্কটা শুধু বন্ধুত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। দু’জন দু’জনকে গভীরভাবে শুধু ভালই বাসেননি, প্রেমেও পড়েছিলেন। মার্গারিট তার ধর্মীয় সংস্কারের কারণে এবং সুনীল তার বাস্তব পরিস্থিতি ও দেশে ফেরার টানে প্রকাশ্যে এ প্রেমের কথা একে-অপরের কাছে স্বীকার করেননি। অবশ্য শেষের দিকে মার্গারিট অনেকখানি দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন, ভালবাসা ও ধর্মীয় বিশ্বাসের টানাপোড়নে ভেঙ্গে পড়েছিলেন। অন্যদিকে সুনীল নিজেকে সামলে নিতে পারলেও মার্গারিটের জন্য তার হাহাকারের কথা বহুবার স্বীকার করেছেন তার লেখায়।
মার্গারিটের সঙ্গে সুনীলের বন্ধুত্বের সূত্রপাতটা ছিল বেশ মজার। একদিন সুনীল তার ‘ক্রিয়েটিভ রাইটিং প্রোগ্রাম’-এ অংশগ্রহণকারী বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করেছিলেন বাসায়। ওই দলে মার্গারিটও এসেছিলেন তার এক বান্ধবীর সঙ্গে। যাওয়ার সময় মার্গারিট তার একটি বই ফেলে রেখে যান সুনীলের বাসায়। পরের দিন বইটা নিতে যাওয়ার সময় মার্গারিট বলেন, তিনি শকুন্তলা উপাখ্যানটা বুঝতে চান। সুনীল যদি তাকে এটা বুঝিয়ে দেন, তাহলে তিনিও তাকে অনেক ফরাসী কবিতা পড়ে শোনাবেন। এ প্রস্তাবে সুনীল খুশী হয়েছিলেন। কিন্তু এরপর মার্গারিটের আর দেখা নেই। সুনীলও তাকে মনে মনে খুঁজছিলেন, কিন্তু লজ্জায় কাউকে সে কথা বলতে পারছিলেন না। পরে একদিন লাইব্রেরীতে দেখা হলে সুনীল তাকে বললেন, ‘কী ব্যাপার শকুন্তলার উপাখ্যান শুনতে তুমি আর এলে না?’ জবাবে মার্গারিট বলেন, ‘তুমি তো আমাকে ডাকোনি।…আমি নিজে থেকে তোমার বাড়িতে দু’বার গেছি। তারপরও কি আবার সেধে সেধে যাব ?’
মূলতঃ এ ঘটনার পর থেকেই দু’জনের বন্ধুতের শুরু। পরবর্তীকালে দু’জনের সম্পর্কটা যখন গাঢ় হয়, তখন মার্গারিট একদিন কথায় কথায় বলেন, বইটা তিনি সুনীলের বাসায় ইচ্ছে করেই ফেলে রেখে গিয়েছিলেন। যাতে তার সঙ্গে আরেকবার দেখা হয়। জবাবে সুনীলও বলেন, লাইব্রেরীতে মার্গারিটের সঙ্গে তার হঠাৎ দেখা হয়নি। তার দেখা পাওয়ার জন্য তিনিও কয়েকদিন ধরে লাইব্রেরীতে যাওয়া-আসা করছিলেন। সুনীল লিখেছেন, পুরনো এ ঘটনাটা নিয়ে পরে তারা দু’জনেই বেশ হাসাহাসি করেছেন।
মার্গারিট ছিলেন গোঁড়া ক্যাথলিক পরিবারের মেয়ে। তার দুই বোন ছিল নান্ (সন্ন্যাসিনী)। সুনীল লিখেছেন, মার্গারিটের বাড়িতে যাওয়ার কথা শুনে মার্গারিট তার হাত চেপে ধরে কাতর গলায় বলেছিল, “সুনীল, প্লীজ, তুমি আমাকে বিয়ে করতে চেও না।… তুমি চাইলে আমি না বলতে পারব না। কিন্তু আমার মা-বাবা এমন কষ্ট পাবেন, আমার অসুস্থ মা এমন আঘাত সহ্য করতে পারবেন না। না, না, তা আমি পারব না।
এর দুই-তিন বছর পর স্বাতীর প্রেমে বাঁধা পড়েন সুনীল। তবে স্বাতীকে সুনীল মার্গারিটের সব কথাই খুলে বলেছিলেন এবং একই সঙ্গে মার্গারিটকেও জানিয়েছিলেন স্বাতীর কথা। মার্গারিট মেনে নিয়েছিলেন সবকিছু। স্বাতীও মার্গারিটকে চিঠি লিখেছিলেন। মার্গারিট শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন সুনীল-স্বাতীর বিয়েতে।
সুনীলের বিয়ের কয়েক বছর পর মার্গারিটের জীবনে ঘটে এক দুঃখজনক ঘটনা। শ্বেতাঙ্গ মার্গারিটকে একদিন রাস্তা থেকে একটি মাইক্রোতে করে তুলে নিয়ে যায় কয়েকজন কৃষ্ণাঙ্গ দুর্বৃত্ত। তারপর তার আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি.......।
সুনীল লিখেছেন, “মার্গারিটের কাছ থেকে আমি অনেক দূরে সরে এসেছি। আমার বয়স বেড়েছে, কিন্তু তার বয়স একটুও বাড়েনি… মার্গারিট বেঁচে থাকলে এতদিনে তার সঙ্গে আমার কী রকম সম্পর্ক হতো, তা জানি না। তবে ফরাসী দেশের মাটিতে পা দিলেই আমি যেন শুনতে পাই তার যৌবনময় কণ্ঠস্বর। তার উচ্ছসিত হাসির শব্দ, তার চোখ দিয়েই এখনো অনেক কিছু দেখি।"
তথ্যসূত্রঃ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'পায়ের তলায় সর্ষে" এবং "ছবির দেশে, কবিতার দেশে" উপন্যাস।
বিঃদ্র- কিছু পার্সোনাল রহস্য লুকিয়ে আছে,,,,,,,, সরি আপু
কোন মন্তব্য নেই
মনে রাখবেন: এই ব্লগের কোনও সদস্যই কোনও মন্তব্য পোস্ট করতে পারে৷